অনলাইনে বাড়তি আয়ের সুযোগ

চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য কাজের পরিবেশ উদ্যম জোগাতে পারে চাকরির পাশাপাশি বাড়তি কিছু আয়ের জন্য অনলাইনে কাজ করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন স্রেফ বাড়তি উদ্যম, ধৈর্য আর কাজের দক্ষতা।
জাহেদুর রহমান কাজ করেন বাংলাদেশের একটি সফটওয়্যার নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে। তাঁর দক্ষতা প্রোডাক্ট বা মেকানিক্যাল ডিজাইনে। লেখাপড়া শেষ করে প্রয়োজনের তাগিদে চাকরি নিয়েছিলেন তাঁর বর্তমান প্রতিষ্ঠানে। অফিসে পুরো সময় দেওয়ার পর রাতে, সকালে আর ছুটির দিনে অনলাইনে কাজ করেন।
জাহেদুর রহমানের ভাষ্য, ‘আমি মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করি। কিন্তু গত এক মাসে অনলাইনে কাজ করে আমি বাড়তি ৬৫ হাজার টাকা
আয় করেছি। ওডেস্ক আর ইল্যান্স মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ নিই; ডিজাইনের কাজ করি আমি।’
তিনি জানান, অনলাইনে বিভিন্ন কাজের সুযোগ রয়েছে। চাকরির দক্ষতা অনলাইনের কাজে লাগানো যেতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ধৈর্য থাকতে হবে। অফিস থেকে বের হয়ে আবার কাজ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। ভালো ইংরেজি বুঝতে হবে এবং স্কাইপ, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের ব্যবহার জানতে হবে। অনলাইনে পেশাদার মানসিকতা নিয়ে বসতে হবে।
অনলাইনে আয় করাটা খুব সহজ নয়, আবার খুব সহজ। চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে আয়ের জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। প্রথমে কাজ পেতে হয়তো সমস্যা হবে। ‘ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে চাকরির পাশাপাশি আয় করাটা সহজ।’ বললেন জাহেদুর রহমান। তাঁর স্বপ্ন নিজেই এবার উদ্যোক্তা হবেন। একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নতুনদের কাজ শেখানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।
তিনি বলেন, তাঁর অনেক বন্ধুই চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে আয় করছেন। তাঁর ভাষ্যে, বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের অনেকেই এখন অফিসের বাইরেও ফ্রিল্যানসিং করছেন। অন্যান্য পেশার ফ্রিল্যানসারদের সংখ্যা কম। তবে উদ্যোগী হলে অনেকেই বাড়তি কিছু আয় করতে পারেন। এ জন্য প্রয়োজনে কিছু প্রশিক্ষণ নিয়েও কাজ করতে পারেন তাঁরা।
দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করেন মোবারক হোসেন। প্রথম আলো অনলাইনকে মোবারক হোসেন খান তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, বাড়তি কিছু আয়ের জন্যই তিনি ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যানসার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন ২০১১ সালে। ওডেস্ক প্ল্যাটফর্মে প্রতি ঘণ্টায় তাঁর বর্তমান আয় ৩০ ডলার। আর হিসাব করলে সপ্তাহ শেষে এ আয় দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার ২০০ ডলারে। ব্যাংকের পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করেন বলে তিনি শুরু থেকেই ওডেস্কে এ ধরনের প্রকল্পের কাজ খুঁজছিলেন। তবে শুরুটা করেন ডাটা এন্ট্রি কাজের মধ্য দিয়ে।
তিনি আরও জানান, ওডেস্ক বা এজাতীয় প্ল্যাটফর্মে বাংলদেশি ফ্রিল্যানসারদের অবস্থান ভালো। ব্যবসার পরিকল্পনা, গ্রাফিকস, মেকানিক্যাল—এসব ক্ষেত্রে খুব কম উপস্থিতি দেখা যায়। ব্যবসার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে বড়জোর তিন-চারটি বিড করা হয়। এখানে সম্ভাবনা আছে। দক্ষতা থাকলে তবেই কাজ শুরু করা উচিত। দক্ষ হয়ে কাজ না করলে দেশি ফ্রিল্যানসারদের কাজের মান নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে, যার প্রভাব খুব ভালো না-ও হতে পারে। কাজ জানা থাকলে সবার জন্য সম্ভাবনার ক্ষেত্র ফ্রিল্যানসিং।
কাজের ক্ষেত্রে ধৈর্য, উদ্যমকে গুরুত্ব দিয়ে মোবারক হোসেন বলেন, সাহস করে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রোফাইল উন্নত করা প্রয়োজন সবার আগে। যিনি কাজ দেবেন, ওই বায়ার যদি সন্তুষ্ট হন, আর ভালো মন্তব্য করেন, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। অবশ্য অতি-উত্সাহী হওয়া উচিত নয়। সম্ভাবনা আর মেধা কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের উত্সাহিত করতে হবে।
একটি প্রতিষ্ঠানের আইটি বিভাগে কাজ করছেন রুবেল আহমেদ। প্রতিষ্ঠানটির বড় পদেই কাজ করছেন তিনি। তার পরও তিনি ফ্রিল্যানসিং করছেন। তাঁর ভাষ্য, বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে ফ্রিল্যানসারদের সংখ্যা বাড়ছে। কাজে দক্ষতা অর্জন করে ফ্রিল্যানসিং করলে আয় করা সহজ।
অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইল্যান্সে কাজ করে বর্তমানে এর কান্ট্রি ডিরেক্টর পদে চাকরি করছেন সাইদুর মামুন খান। ইল্যান্সের কান্ট্রি ডিরেক্টর সাইদুর মামুন খান এ প্রসঙ্গে বলেন, অনলাইনে আয়ের জন্য বয়স, পেশা বা চাকরি কোনো বিষয় নয়। দ্রুত গতির ইন্টারনেট, ভালো কম্পিউটার, দক্ষতা, উদ্যম আর মানসিকতা থাকলেই কাজ শুরু করা সম্ভব। বাড়তি আয়ের জন্য চাকরির পাশাপাশি অন্য কাজ করাই যায়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় অনলাইনে থাকার প্রয়োজন পড়ে।
ফ্রিল্যানসার হিসেবে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কাজ করছেন জাহরা জাহান। তাঁর ভাষ্য, ‘আমরা উদ্যোক্তা, চাকরির পেছনে ছুটছি না। আমরা চাকরি করব না, আমরা চাকরি দেব।’
বেসিসের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামীম আহমেদের ভাষ্য, ফ্রিল্যানসাররাই হচ্ছেন আগামী দিনের উদ্যোক্তা। ফ্রিল্যানসাররা সচেতন হলে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব। ফ্রিল্যানসিংয়ের যেকোনো কাজের সঙ্গে বেসিস থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিডিওএসএনের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানের ভাষ্য, ২০১২ সালে বাংলাদেশের ফ্রিল্যানসাররা আউটসোর্সিং থেকে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা আয় করেছেন। একাজে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা ও উত্সাহ প্রয়োজন। বাংলাদেশে ফ্রিল্যানসিংয়ে নারীদের সংখ্যা কম। শুধু চাকরি না খুঁজে বা চাকরির পাশাপাশি নারীরাও ফ্রিল্যানসিং করে আয় করতে পারেন বলেই জানিয়েছেন তিনি।

নতুনদের জন্য পরামর্শ
আউটসোর্সিংয়ের কাজ করেন এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা ওডেস্ক ডটকমে চার-পাঁচটি কাজের আবেদন করেই কাজ (জব) পেয়ে যান। আবার কেউ কেউ ১০০টি আবেদন করেও কাজ পান না। এটা অনেকটা নির্ভর করে আপনি কত কম পারিশ্রমিকে (ডলার) আবেদন করেছেন, তার ওপর।
এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, আপনার কাজের মানের ওপর পারিশ্রমিক দাবি করবেন। এ জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। একটি ৫০ ডলারের কাজ পাওয়ার জন্য পাঁচ ডলার চাওয়া মোটেও উচিত নয়। এতে যিনি কাজ দেন, তাঁর মনে আপনাকে নিয়ে এবং আপনার কাজের মান নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে পারে।
নতুন যাঁরা ওডেস্কের মাধ্যমে কোম্পানি হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন বা করতে চান, তাঁদের জন্য নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো:
১. যেসব কাজদাতা বা বায়ারের লেনদেন পদ্ধতি পরীক্ষিত (পেমেন্ট মেথড ভেরিফায়েড) হয় না, সেসব বায়ারের জবে আবেদন করবেন না। কারণ, কোনো কন্ট্রাক্টরকে কাজ দিতে গেলে বায়ারের লেনদেন পদ্ধতি পরীক্ষিত থাকতে হয়।
২. কোনো একটা কাজ প্রকাশ (জব পোস্ট) করার পর যত তাড়াতাড়ি সেটিতে আবেদন করবেন, ততই ভালো।
৩. আপনি যত বেশি সময় অনলাইনে (ওডেস্কে) থাকবেন, ততই আপনার কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, কিছু কিছু জব আছে, যেগুলো প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে মানে এক দুই ঘণ্টার মধ্যেই করে জমা দিতে হয়। যেমন—ফেসবুকে বা অন্য কোনো সাইটে ভোট দেওয়া এবং কিছু ভোট সংগ্রহ করে দেওয়া বা হঠাত্ করে কোনো ওয়েবসাইটে সমস্যা হয়েছে, তা ঠিক করে দেওয়া ইত্যাদি।
৪. কাজেই শুরুতে বেশি সময় অনলাইনে থাকার চেষ্টা করুন, যাতে বায়ার আপনাকে কোনো মেসেজ দিলে সঙ্গে সঙ্গে তার রিপ্লাই দিতে পারেন। তাহলে বায়ার বুঝতে পারবেন, আপনি কাজের প্রতি কতটা আন্তরিক।
৫. ওডেস্কে দেখবেন, প্রতি মিনিটে নতুন নতুন জব পোস্ট করা হচ্ছে, সেগুলোতে আবেদন করুন। যেসব জবে কোনো কনট্রাক্টরকে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছে, সেসব জবে আবেদন না করাই ভালো।

লেখক: মিন্টু হোসেন
প্রকাশিত:০১-০২-২০১৩