চলুন গুগল অনুবাদকে হাত লাগাই

এত দিন গুগলে অনেক ভাষার জন্য অনুবাদের সুবিধা ছিল।এখন এতে বাংলা ভাষাও যোগ করা হয়েছে। গুগল ট্রান্সলেটর বা গুগল অনুবাদক দিয়েবাংলা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ, আবার উল্টোটাও করা সম্ভব হচ্ছে। গুগল ট্রান্সলেটর হচ্ছে গুগলের তৈরি বিনা মূল্যের একটি যান্ত্রিক অনুবাদক। এই অনুবাদকটি ব্যবহার করে যেকোনো লেখা, ডকুমেন্ট ও ওয়েবসাইট সরাসরি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যায়। ২০০৬ সালের এপ্রিলে এটি চালু করা হয়। প্র্রাথমিক অবস্থায় এখানে শুধু আরবি ভাষা থেকে ইংরেজি এবং ইংরেজি থেকে আরবিতে অনুবাদ করা যেত। পরে ধীরে ধীরে এখানে নতুন নতুন ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সব সময়ই এর মান উন্নয়ন এবং নতুন ভাষা সংযোজনের কাজ চলছে। বর্তমানে গুগল ট্রান্সলেটরে ৬৩টি ভাষা রয়েছে। এ ৬৩টি ভাষায় একটি থেকে অন্য যেকোনোটিতে অনুবাদ করা যায়।

এই গুগল ট্রান্সলেটরে বাংলাসহ নতুন পাঁচটি ভাষা সংযোজন করা হয়েছে কিছুদিন আগে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অংশে ব্যবহূত এই ভাষাগুলোর আলফা অর্থাৎ প্রাথমিক সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাভাষা যুক্ত হওয়ার ফলে এই অনুবাদকের মাধ্যমে এখন যেকোনো ওয়েবসাইট বা ডকুমেন্ট অনুবাদ করা যাবে। http://translate.google.com ঠিকানা থেকে এই অনুবাদকটি ব্যবহার করা যাবে। গুগল ট্রান্সলেটর একটি অনলাইন প্রোগ্রাম।কম্পিউটার ইনস্টল না করেই ওয়েবসাইট দেখার সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করা যাবে। ব্যবহার করার পদ্ধতিটি বেশ সহজ। এই অ্যাপলিকেশনটিতে লেখার জন্য একটি জায়গা নির্ধারণ করা আছে। যে লেখাগুলো অনুবাদ করতে হবে, সেগুলো এই অংশে লিখতে হবে। যে ভাষাতে লেখা হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে ভাষার নাম From অংশে দেখা যাবে এবং এই ভাষা থেকে যে ভাষায় অনুবাদ করা হবে, সেটি To অংশ থেকে নির্ধারণ করতে হবে। তবে From অংশে যদি ভুল ভাষার নাম দেখানো হয়, তবে তালিকা থেকে সঠিক ভাষার নাম নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে।

গুগলের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে নতুন যুক্ত করা এই ভাষাগুলোতে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৫০ কোটি মানুষ কথা বলে এবং দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত তারা অনুবাদকে এই ভাষাগুলো যুক্ত করতে পেরেছে।

বাংলা ভাষায় বাক্য গঠনপদ্ধতি ইংরেজি থেকে অনেকাংশেই আলাদা। ফলে বাংলা বাক্যসমূহের সঠিক অনুবাদ করার কাজটি তুলনামূলক কঠিন। আবার এই ভাষায় এমন বেশ কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন স্থানভেদে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। এ ধরনের শব্দগুলোর সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি নিয়েও গবেষণার কাজ চলছে।

যান্ত্রিক অনুবাদক তৈরির জন্য সাধারণত দুই ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একটি হলো অনুবাদ করার জন্য ট্রান্সলেটরে বিশেষ কিছু নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা এবং অনুবাদক সেই নিয়মগুলো মেনে অনুবাদের কাজ করে থাকে। অপরটি হলো পরিসংখ্যানগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনুবাদ। গুগল ট্রান্সলেটর দ্বিতীয় পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। গুগলের এই অনুবাদকটি সরাসরি ব্যাকরণের নিয়মনীতি অনুযায়ী অনুবাদ করে না। অনুবাদের জন্য এই বিশেষ পদ্ধতিটি ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল মেশিন ট্রান্সলেশন’ নামে পরিচিত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এই অনুবাদের পদ্ধতিটি পরিসংখ্যানগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। এই পদ্ধতিতে অনুবাদের জন্য ট্রান্সলেশন মেমরি প্রয়োজন হয়। কোনো একভাষার বাক্যের বিপরীতে কী অনুবাদ করা হয়েছিল, সেগুলো ট্রান্সলেশন মেমরি হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। এই মেমরির সঙ্গে মিল রয়েছে, এমন নতুন কোনো বাক্য অনুবাদ করার সময় আগের অনুবাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন অনুবাদ করা হয়। এই ট্রান্সলেশন মেমরির পরিমাণ যত বেশি হবে, নতুন অনুবাদের ক্ষেত্রে এটি তত বেশি সঠিক এবং কার্যকর ফলাফল দেখাবে। পাশাপাশি প্রয়োজন একটি সমৃদ্ধ শব্দকোষ বা গ্লোসারি।

গুগল ট্রান্সলেটরে বাংলাভাষা আলফা সংস্করণ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ এটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক নয়। তবে গুগলের পাশাপাশি অন্য যে কেউ এই অনুবাদকের মানোন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অনুবাদকের মানোন্নয়নের দুই ধরনের পদ্ধতি রয়েছে।

ত্রুটিপূর্ণ অনুবাদ সংশোধন
অনুবাদক ব্যবহার করে কোনো বাক্যাংশ অনুবাদ করা হলে যদি সেখানে ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ অনুবাদ দেখানো হয়, তবে সেটি সেখান থেকেই সংশোধন করে দেওয়া যাবে। অনুবাদ ফলাফলের শব্দগুলোর ওপর মাউস দিয়ে ক্লিক করলে সেই শব্দগুলোর বিকল্প শব্দ দেখানো হয়। সঠিক শব্দটি যদি সেখানে না-ও থাকে, তবে সেখানে সঠিক শব্দটি যোগ করে দেওয়া যাবে।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষার বাক্য গঠনপদ্ধতি একধরনের নয়। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাক্যে শব্দগুলো এলোমেলোভাবে দেখাতে পারে। এ ধরনের ফলাফলের ক্ষেত্রে শব্দগুলো পুনর্বিন্যাস করে সঠিক বাক্যটি তৈরি করা যাবে। যে শব্দগুলো সঠিক স্থানে নেই, কিবোর্ড থেকে শিফট বাটন চেপে সেটি নির্বাচন করে সঠিক স্থানে বসিয়ে দেওয়া যাবে। এভাবে সংশোধন করা হলে পরে এ ধরনের অনুবাদের ক্ষেত্রে সঠিক অনুবাদ দেখাবে।

অনুবাদের হাতিয়ার
গুগল ট্রান্সলেটরে অনুবাদের মানোন্নয়নের জন্য গুগলের ট্রান্সলেশন টুলকিট নামে বিশেষ একটি প্রোগ্রাম রয়েছে। http://translate.google.com/toolkit ঠিকানা থেকে এটি ব্যবহার করা যায়। প্রাথমিকভাবে এটি দেখতে একটি সাধারণ ‘টেক্সট এডিটর’ বলে মনে হতে পারে। এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুবাদ করা যায় না; বরং কোনো ব্যবহারকারীকে নির্দিষ্ট কোনো ভাষার বাক্যাংশ অনুবাদ করতে হবে। ধরা যাক, ইংরেজি ভাষার কোনো ডকুমেন্ট এই টুলকিটের মাধ্যমে বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ইংরেজি বাক্যের বিপরীতে কী বাংলা বাক্য ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো ট্রান্সলেশন মেমরি হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। এভাবে নিয়মিত এই টুল ব্যবহার করে অনুবাদ করা হলে ধীরে ধীরে অনুবাদকটির মান উন্নত হবে।

ট্রান্সলেশন টুলকিট ব্যবহারের সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে অনুবাদের ভাষা যেন সাবলীল হয় এবং কোনো অপ্রচলিত শব্দ যেন ব্যবহার না করা হয়। শুধু আক্ষরিক বা ভাবানুবাদ না করে, প্রাসঙ্গিকভাবে প্রয়োজনে দুটির সংমিশ্রণে অনুবাদ করা যেতে পারে। সব সময়ই খেয়াল রাখা উচিত যে শব্দগুলো সাধারণভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে অনুবাদের ক্ষেত্রে, সে শব্দগুলো ব্যবহার করা উচিত। যেমন, Oxygen এর বাংলা হিসেবে যদি অম্লজান শব্দটি লেখা হয়ে থাকে, তবে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই সেটি বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য হবে। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

গুগল ট্রান্সলেটরে বর্তমানে ৬৩টি ভাষা রয়েছে। ফলে শুধু ইংরেজি থেকে বাংলা অথবা বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদকের মানোন্নয়ের জন্য কাজ করার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার জন্যও একই পদ্ধতিতে অনুবাদকের মানোন্নয়নের জন্য কাজ করা যাবে এবং ইংরেজির পাশাপাশি অন্যান্য ভাষারা ক্ষেত্রে অনুবাদক যদি সঠিকভাবে কাজ করত, তবে বাংলাভাষা ব্যবহারকারীরা সেই ভাষার তথ্যগুলো সহজেই পড়তে পারবে।


লেখক: নাসির খান

প্রকাশিত: প্রথম আলো ঢাকা, শনিবার, ৩১ আগস্ট ২০১৩, ১৬ ভাদ্র ১৪২০, ২৩ শাওয়াল ১৪৩৪