ছোটবেলায় স্কুলে অনেক
সময় পরীক্ষায় বা ক্লাসে অনুশীলন হিসেবে অনুবাদ করতে দেওয়া হত। সেই অনুশীলনকেই আজকের
দিনে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেকে। লিখছেন ওড়িয়া থেকে বাংলায় সাহিত্য অনুবাদ
নিয়ে সম্প্রতি এক কর্মশালা থেকে বেরিয়ে শুরু হয়েছিল তর্কটা। দ্বিতীয় বর্ষের দুই
সাহিত্যের ছাত্রী আলোচনা করছিল ওড়িয়া গল্প অনুবাদ করতে গিয়ে সব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ
না পাওয়া গেলে কত রকম সমস্যা হচ্ছে তাদের কাজে। আরও দু’জন তাতে ঢুকে পড়ায় কথা গড়াল
অনুবাদের নানা সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে।
‘শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ
করতে হয় নাকি?’
‘কিন্তু, তা হলে অনুবাদ
হবে কী করে?’
‘অনুবাদ তো হবে বক্তব্য
ও ভাব, শব্দ নয়।’
‘তবে কী হবে কবিতার
ক্ষেত্রে? শব্দ না ছন্দ গুরুত্ব কীসের?’
‘এত সহজ নয় বলেই তো
আলাদা করে অনুবাদক নিয়োগ করা হয়। তাই তো অনুবাদ ঘিরে এতো পড়াশোনা। প্রতিশব্দ বসালেই
যদি হত, তবে তো ভাষা জানলে যে কেউ অনুবাদ করতে পারত।’
অনুবাদ সংক্রান্ত এমন
নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং ছাত্রছাত্রীদের হাতে-কলমে সাহিত্য অনুবাদের প্রশিক্ষণ
দিতেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ট্রান্সলেশন অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচারস্’
(সেন্টিল) আয়োজন করেছিল ওড়িয়া-বাংলা-ইংরেজি অনুবাদের কর্মশালা। সেখানেই উঠল অনুবাদকের
কাজের সুযোগ, গুরুত্ব ও দায়িত্বের প্রশ্ন। প্রতিষ্ঠিত অনুবাদকদের সঙ্গে কথা বলে ছাত্রছাত্রীরাও
জানতে পারল নতুন নতুন কত ধরনের কাজের সুযোগ বাড়ছে এই ক্ষেত্রে।
ছোটবেলায় স্কুলে নিশ্চয়ই
কখনও খেলার ছলে অথবা ক্লাস ওয়ার্ক হিসেবে বহু ইংরেজি বাক্য বাংলায় বা বাংলা থেকে
ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হয়েছে। সে কাজকেই কিন্তু এখন অনেকে অনায়াসে নিজের পেশা হিসেবে
বেছে নিচ্ছেন।
বিশ্বায়নের যুগে নানা
ভাষী মানুষের কাছাকাছি আসার সুযোগ ও প্রয়োজন রোজই বাড়ছে। বেড়ে চলেছে ভাষায়-ভাষায়
যাতায়াতও। তাই গুরুত্ব পাচ্ছে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও একে-অপরকে জেনে নেওয়ার দিকটাও।
সে কারণেই দিন দিন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বের
দিকে নজর পড়ছে। বহুজাতিক সংস্থা থেকে ফিল্ম প্রডাকশন, পত্রপত্রিকা নানা জায়গায় এখন
অনুবাদকদের কাজের নিত্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
শুধু বিশ্বায়নই কেন?
আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই ব্যবহার হয় অনেক ভাষা। তার মধ্যে বহু ভাষায় নিয়মিত
সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। সে সব ভাষার সঙ্গে আদানপ্রদান বাড়িয়ে নিজের মাতৃভাষাকে
সমৃদ্ধ করতেও উদ্যোগী অনেকে। এত দিন আমাদের দেশে এমন উৎসাহ তুলনায় কম ছিল বলেই হয়তো
অনুবাদের দিকে তেমন জোর দেওয়া হয়নি। সে কারণেই অনুবাদকের কাজও তেমন গুরুত্ব পায়নি
বলে মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক তথা সেন্টিল-এর
সঞ্চালক অভীক মজুমদার ও সায়ন্তন দাশগুপ্ত। তাঁরা জানান, সাহিত্য অকাদেমির পাশাপাশি
এখন বেশ কিছু ছোট-বড় প্রকাশনা সংস্থাও ভাষা সাহিত্য অনুবাদে জোর দিচ্ছে। তাই আজকাল
সে সব ক্ষেত্রেও অনুবাদকের বিশেষ চাহিদা
তৈরি হয়েছে ।
কী জানা প্রয়োজন?
ভাল অনুবাদ করতে পারা
খানিকটা ভাল অঙ্ক জানার মতো ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় চর্চার।
তবে অনুবাদ করাকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিতে হলে অন্তত দু’টো ভাষার ওপরে যথেষ্ট দক্ষতা
থাকতেই হবে। যাতে সে ভাষায় লেখা যে কোনও কথা ভাল ভাবে বুঝতে পারা যায়। সে ভাষাটা
হয়তো বোঝেন না অনেকেই। অনুবাদকের কাজ, অন্য একটা ভাষায় সেই কথাটা গুছিয়ে লেখা। তাই,
ভাল লিখতে জানাও প্রয়োজন এ কাজের জন্য। শুনতে যত সহজ, কাজটি কিন্তু তত সহজ নয়। যেমন
অভীকবাবু মনে করিয়ে দেন, “শুধু দু’টো ভাষায় দক্ষ হলেই অনুবাদ করা যায় না। বড় জোর
ভাষান্তর করা যেতে পারে।” সঠিক অনুবাদের জন্য খেয়াল রাখতে হয় অনেক দিকে। কী অনুবাদ
করছি, সেটার পাঠক কারা কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
কারণ ভাষা মানে শুধু কয়েকটা শব্দ নয়। সব ভাষায় যে কোনও শব্দ প্রয়োগের একটা সাংস্কৃতিক
প্রেক্ষাপট রয়েছে। তাই যে কোনও ভাষা থেকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে সে সব
দিকেও। তাই পেশাদার অনুবাদক হতে চাইলে সে সংক্রান্ত কোর্সও করা যায় এখন।
কোথায় শেখা যায় কাজ?
আগে হাতে কলমে অনুবাদ
শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না এখানে। তবে পরিস্থিতি এখন বদলাচ্ছে। অনুবাদকের চাহিদা
যেমন বাড়ছে, তেমনই অনুবাদ নিয়ে পড়াশোনার সুযোগও তৈরি হচ্ছে আমাদের দেশে। কলকাতায়
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ট্রান্সলেশন অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচারস্’-এ অনুবাদ
নিয়ে এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়। সেখানে নিজে হাতে নানা ধরনের লেখা অনুবাদ
করার মাধ্যমেই পড়াশোনা হয় বলে জানান সায়ন্তনবাবু। সেন্টারের শিক্ষকদের পাশাপাশি
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুবাদের কাজের সঙ্গে যুক্ত এমন শিক্ষকেরাও এসে ক্লাস নেন। তাতে কাজের
ক্ষেত্রে বাস্তব সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে জেনে নিতে পারেন ছাত্রছাত্রীরা। এ ছাড়া ওড়িশার
সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়, পুণে বিশ্ববিদ্যালয়, আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়,
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়, কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের
বিভিন্ন বিভাগে অনুবাদ নিয়ে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা কোর্স করা যায়।
কাজের সুযোগ?
কেন্দ্রীয় সরকারের
বিভিন্ন দফতরে অনুবাদকের চাকরির সুযোগ রয়েছে। অনুবাদ চর্চায় উৎসাহ থাকলে কাজ পাওয়া
যেতে পারে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থায়। শুধু ভাষা সাহিত্যই নয়, নানা বিজ্ঞান থেকে সমাজ
বিজ্ঞান সব বিষয়ের বইয়ের অনুবাদই বাড়ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত অনেক কোর্সের পাঠ্যক্রমেই
জোর দেওয়া হয় সংবাদমাধ্যমের জন্য অনুবাদের উপরে। কারণ, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার দফতরে
নানা ক্ষেত্রে কাজ করেন অনুবাদকেরা। নাম করা কিছু আন্তর্জাতিক পত্রিকা এখন ভারতীয়
ভাষায় তাদের সংস্করণ প্রকাশ করছে। সে সব সংস্থায়ও অনুবাদক হিসেবে কাজের সুযোগ রয়েছে।
ভারতবর্ষের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে এখন বিদেশে অনেক গবেষণা হয়। ইংরেজি ভাল জানা
থাকলে তেমন গবেষণার জন্য স্থানীয় ভাষায় লেখা নথিপত্র অনুবাদের কাজও করা যায়।
নানা ভাষার চলচ্চিত্রের
সাব-টাইটেল তৈরিতেও অনুবাদকদের সাহায্য প্রয়োজন হয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোডাকশন
হাউজেও অনুবাদকদের কাজের সুযোগ বাড়ছে। কোনও বিদেশি ভাষা জানা থাকলে, বিভিন্ন বহুজাতিক
সংস্থায় নথিপত্র অনুবাদের জন্য নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া, বিভিন্ন অ্যাড এজেন্সিতে
কোনও জিনিসের লিটারেচার এবং বিজ্ঞাপনের বয়ান অনুবাদের কাজের সুযোগও রয়েছে। কোথাও
কোথাও স্থায়ীকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হয়, কথাও ফ্রিলান্স অনুবাদক হিসেবেও কাজের সুযোগ
খুলছে।
এ ছাড়াও ভাষা ও সাহিত্যে
নিয়ে কাজ করতে ভাল লাগলে আরও অনেক কিছুই করা যায়। যেমন অভীকবাবু মনে করিয়ে দেন,
কয়েক জন সাহিত্যিক এবং অনুবাদক ছাড়া আর কেউ তেমন ভাবে বিদেশি সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ
করেননি। সেই খামতিটা পুরণ করার উদ্যোগ নিলে বাংলা সাহিত্যের খুব উপকার হবে। ভাল অনুবাদ
সাহিত্যে পাঠক অনেক আছেন। তার সাপেক্ষে বাংলায় অনুবাদের কাজ তেমন হচ্ছিল না।
লেখক: সুচন্দ্রা ঘটক
প্রকাশিত: আন্দবাজার
পত্রিকা ৫ ভাদ্র ১৪১৮ সোমবার ২২ আগস্ট ২০১১